বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয়চন্দ্র মন্ডলের গ্রেফতার হওয়া এবং ১৯দিন জেলহাজতের পর জামিনে মুক্ত হওয়া সাম্প্রতিক সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তাঁর অপরাধ; তিনি বিজ্ঞানকে ধর্মের থেকে পৃথক করে, বলা ভাল বিজ্ঞানকে ধর্মের থেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। অথচ ধর্ম অবমাননার দায়ে তাঁকে গ্রেফতার হতে হয়। একজন ছাত্র বিজ্ঞানের ক্লাসে তাঁর বক্তব্য রেকর্ডিং করে ছড়িয়ে দেয়। তারপর কিছু ছাত্র-ছাত্রী এবং এক শ্রেণীর মৌলবাদী মানুষ তাঁকে গ্রেফতারির দাবি তোলে। যথারীতি গ্রেফতার হন হৃদয় মন্ডল। কোর্টও তাঁর ২ বার জামিন নাকচ করে। বাংলাদেশের নাগরিক সমাজে হৃদয় মন্ডলের মুক্তির দাবীতে আন্দোলন শুরু হয়। শাহবাগ চত্ত্বর থেকে ঢেউ আছড়ে পড়ে বুদ্ধিজীবি সমাজে। হৃদয় মন্ডলকে নিয়ে গান লেখেন প্রিন্স মাহমুদ। সেই গান বাংলাদেশের ছাত্র সমাজের কন্ঠে ধ্বনিত হয়, ইউটিউবে কোটিবার দেখা হয়। অবশেষে নাগরিক সমাজের চাপে জামিন পান হৃদয় মন্ডল। ইউটিউব থেকে যে অডিও রেকর্ডিং আমারা শুনেছি তাতে বোঝা যাচ্ছে হৃদয় মন্ডল ছাত্রটির প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন এবং সেই সূত্রে তিনি ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন যে, বিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞানের প্রশ্নকে ধর্মের আদল দেওয়া ঠিক নয়। প্রসঙ্গত হিন্দু ধর্মে বর্ণিত হনুমানের কানের ভেতরে সূর্যের অবস্থানকেও তিনি অস্বীকার করছিলেন। অথচ কোরান অবমাননার দ্বায়ে তাঁকে গ্রেফতার হতে হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি যেমন - পরিবার, বিদ্যালয়, ধর্মস্থান প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা ভূমিকা আছে। বিদ্যালয়কে ধর্মস্থানের রূপ দিতে চাইলে ঠিক হবে না। বিদ্যালয়ে যুক্তিবাদীতাই এবং মুক্তবুদ্ধি স্থান পাবে। এটা আসলে প্রতিষ্ঠান ভেঙে দেওয়ার সুচারু পরিকল্পনা। ভারতবর্ষ, পাকিস্তানে ধর্মগুরুদের বাড়বাড়ন্ত দেখে এর অন্যথা মনে হয় না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন গণেশের শুঁড় আসলে প্রাচীন ভারতের প্লাস্টিক সার্জারির উদাহরণ বা ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী যখন বলেন মহাভারতে সঞ্জয়ের আখ্যান আসলে প্রাচীন ভারতের ইন্টারনেট ব্যবস্থার উদাহরণ, তখন আমাদের বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না কেন দেশে মৌলবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে। আমাদের মনে পড়বে 'দাদাগিরি'তে 'সুপার ন্যাচারাল' শক্তির প্রসঙ্গে কয়েকটি ডিভাইস দেখিয়ে রাতারাতি বিখ্যাত হওয়া একটি দলের কথা। যখন তাদের কাছে 'ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি'র চ্যালেঞ্জ যায় তাদের বক্তব্য প্রমাণের, তাদের আর পাত্তা পাওয়া যায় না। সম্প্রতি ডারউইনকে দিয়ে কোরানের ব্যাখ্যা মূর্খতার অন্যতম নজির, যা নিয়ে বেশ হাসাহাসিও হচ্ছে। আচ্ছা ভেবে দেখুনতো ক্রোমোজম থেকে শুরু করে পরমাণু পর্যন্ত - এসবের ব্যাখ্যা ধর্মগ্রন্থে কোথায়? বর্তমানে এই উপমহাদেশে ধর্ম অবমাননার বহু অভিযোগ ওঠে। আচ্ছা, ধর্মের কথা বলতে গিয়ে যে প্রতিদিন বিজ্ঞানের অবমাননা হচ্ছে, তার কি শাস্তি হবে? আমরা যেভাবে ভূত বা ভগবানের গল্পকে সত্যি বলে দেগে দিই, ফলত শিশুমনে ভূতকে নিয়ে ভয় এবং ভগবানে ভক্তি তৈরি হয়। এভাবে যে আমরা শিশুদের চিন্তার স্থবিরতা তৈরি করছি, তার শাস্তিই বা কি হবে? শিশুদের আর দোষ কোথায়! বিজ্ঞানের শিক্ষক যদি তাবিজ-কবজ-রত্ন ধারণ করে বিজ্ঞান শিক্ষা দিতে যান, তখন বুঝে নিতে হয়, তিনি চাকরি পাওয়ার জন্য বিজ্ঞান পড়েছেন, কিন্তু বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠতে পারেননি। যে অভাগা দেশে বিজ্ঞান কংগ্রেসের উদ্বোধন হয় নারকেল ভেঙে বা বিজ্ঞান কংগ্রেসের শিশু অধিবেশনে শিশুদের বোঝানো হয় বিজ্ঞান ও পুরাণ অভিন্ন, সে দেশের আর কিইবা হতে পারে? বিজ্ঞান প্রমাণ ছাড়া কিছু মানে না। যার প্রমাণ নেই তা দর্শন হতে পারে, সাহিত্য হতে পারে, অলৌকিক মায়াজালের কল্পনা হতে পারে; বিজ্ঞান হতে পারে না। তাই বিজ্ঞানচর্চা করতে গেলে ধর্মান্ধতা এবং কুসংস্কার বিসর্জন দিতে হবে, মানবতাকে মুক্ত করতে হবে।
"সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে -- এ-পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে। "